Header Ads Widget

তথ্য অধিকার আইন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার

তথ্য অধিকার আইন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার

    মো. আতিকুর রহমান শাহ্, 

তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী।


রহিমা বেওয়া বয়স ৬৫ ছুঁই ছুঁই। অনেক আগেই স্বামী হারিয়েছে। স্বামী মৃত্যুর পর অন্যের বাসায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ শুরু হয়। বয়সের ভারে সে এখন কাজ করতে পারে না। একটি মাত্র ছেলে বিয়ে করে পৃথক সংসার গড়েছে। রহিমা বেওয়ার দূর্বিসহ দিন কাটে অর্থাভাবে, অনাহারে। কিভাবে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটবে! সে চিন্তায় যেন তার দু‘চোখ অন্ধকার। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার তার আকুতি-মিনতিতে কর্ণপাত করেন না। এমন সময় এলাকার হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে সরকারের প্রদত্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী ও তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে জানান।

 

 

তাকে উপজেলা সমাজসেবা অফিসারের নিকট ভাতা প্রাপ্তির তথ্য চেয়ে আবেদন করতে বলেন এবং এ বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করেন। উপজেলা সমাজসেবা অফিসার রহিমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন এবং তাকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট পাঠান। তখন চেয়ারম্যান তাকে বিধবা ভাতা প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করেন। তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের ফলে রহিমার ভাতা প্রাপ্তি সহজ হয়। রহিমার ভাতা প্রাপ্তির বিষয়টির সাথে এ বছরের শ্লোগানটির যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়; ‘সংকটকালে তথ্য পেলে জনগণের মুক্তি মেলে’।

 


জ্ঞানই শক্তি এ কথাটি সমাজে প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে বলা হচ্ছে তথ্যই শক্তি। ঔপনিবেশিক আমল থেকে প্রায় ১১ শতাধিক আইন প্রয়োগ করা হলেও তথ্য অধিকার আইন এমনই এক আইন, যা জনগণ প্রয়োগের ক্ষমতা রাখে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর মাধ্যমে নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। যার পূর্ণতা দিতে ঔপনিবেশিক আমলের পুরনো ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নতুন মানসিকতা তৈরি করতে হবে। 

 


তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। এতে সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে ও দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের যাত্রা আরো ত্বরান্বিত হবে। তাই তথ্য গোপন করার অপসংস্কৃতি রুখতে হবে।

 


স্বাধীন প্রেস আইন এর মাধ্যমে ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে সুইডেনে প্রথম শুরু হয় তথ্য প্রবাহে জনগণের প্রবেশাধিকারের বিষয়টি। তবে বাংলাদেশে এ আইনটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল হিসেবে পাওয়া যায়। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তথ্য অধিকার আইনের পক্ষে প্রেস কমিশনের সুপারিশ এবং ২০০২ খ্রিস্টাব্দের আইন কমিশনের সূত্র ধরে সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার আইনের দাবি জোরদার করা হয়।

 

 

এরই ধারাবাহিকতায় আইন কমিশন বিভিন্ন দেশের আইন পর্যালোচনা করে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে তথ্য অধিকার আইনের একটি খসড়া সরকারের নিকট পেশ করে। পরবর্তীতে এটির অগ্রগতি না হলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথ্য অধিকার আইনের খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যে ০৬ জানুয়ারি ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে একটি কমিটি গঠন করে অবশেষে ২০ অক্টোবর ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ ২০০৮ জারি করে, যা বর্তমান সরকার ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ পাশ করে। 

 


তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী তথ্য অর্থে কোনো কর্তৃপক্ষের গঠন, কাঠামো ও দাপ্তরিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত যে কোনো স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য, উপাত্ত, লগবহি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনাপত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী, প্রকল্প প্রস্তাব, আলোকচিত্র, অডিও-ভিডিও, অঙ্কিতচিত্র, ফিল্ম, ইলেক্ট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতকৃত যে কোনো ইনস্ট্রুমেন্ট, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে অন্য যে কোনো তথ্যবহ বস্তু বা উহাদের প্রতিলিপি এর অন্তর্ভূক্ত হবে।

 


আইনে তথ্যের সংজ্ঞায় অনেক বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যেগুলো পেলে দুর্নীতি অনেকাংশে বন্ধ করা যাবে। এই আইনে কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞাটিও অত্যন্ত বিস্তৃত যার দ্বারা সকল সংস্থা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত সকল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে কর্তৃপক্ষের আওতায় এনে দায়বদ্ধ করা হয়েছে।

 


আইনের ধারা ৮(১) অনুসারে কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন তথ্য প্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট তথ্য চেয়ে লিখিতভাবে সরাসরি, ইলেকট্রনিক মাধ্যম বা ই-মেইলে অনুরোধ করতে পারবেন। আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ধারা ৮ এর উপধারা ১ এর অধীন অনুরোধ প্রাপ্তির তারিখ হতে ২০(বিশ) কার্যদিবসের মধ্যে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করবেন। এক্ষেত্রে একাধিক তথ্য প্রদান ইউনিট বা কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকলে ৩০(ত্রিশ) কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করতে হবে। অনুরোধকৃত তথ্য কোনো ব্যক্তির জীবন-মৃত্যু, গ্রেফতার এবং কারাগার হতে মুক্তি সম্পর্কিত হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অনুরোধ প্রাপ্তির অনধিক ২৪ (চব্বিশ) ঘন্টার মধ্যে উক্ত বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সরবরাহ করবেন।

 


নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তথ্য লাভে ব্যর্থ হলে কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে উক্ত সময়সীমা অতিক্রান্ত হবার, বা ক্ষেত্রমত, সিদ্ধান্ত লাভ করবার পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে আপীল কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল করতে পারবেন। আপীল সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে তথ্য কমিশনের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।

 


আমরা যদি ঔপনিবেশিক আমল থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হওয়ার পূর্বের অবস্থা বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাই সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তারা যতটা সম্ভব তথ্য গোপনের চেষ্টা করতেন। ঔপনিবেশিক আমলে আইন করেই জনগণের তথ্য দেওয়ার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে যে সংবিধান রচিত হয় সেখানে জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু এ স্বীকৃতিকে আইনি কাঠামোর ভেতরে এনে জনগণকে সরাসরি তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থার জন্যই প্রয়োজন ছিল তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের। সে কাজটিই ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার করেছে।

 

 

এর ফলে জনগণের সামনে তথ্য গোপন রাখার সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে ১০০ ভাগ স্বচ্ছতা এসেছে এটা বলা যাবে না। কিন্তু বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। কাজকর্মে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মানসিকতাতেও পরিবর্তন এসেছে। ভবিষ্যতে আরোও পরিবর্তন হবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। জনগণ তথ্য না পেলে কমিশনে অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ পাচ্ছে। অনলাইনে আবেদন, আপীল ও অভিযোগ দায়েরসহ আবেদনের ট্রাকিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে। 

 


তথ্য অধিকার আইনে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা বিজ্ঞমহলের মন্তব্যে উঠে আসলেও এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে প্রচলিত অন্য কোনো আইনের ক) তথ্য প্রদান সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলী দ্বারা ক্ষুন্ন হবে না। এবং (খ) তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক হলে এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাবে।

 


এ আইনের সুফল ভোগ করতে হলে যে যার অবস্থান থেকে সকল সচেতন নাগরিককে প্রান্তিক জনগণকে আইনটি সম্পর্কে যথাসম্ভব জানাতে হবে। প্রত্যেক তথ্য প্রদান ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আরো বেশি মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হতে হবে। তবে মানুষের কল্যাণে তথ্য অধিকার আইনসহ যত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তার স্বার্থক প্রয়োগ সম্ভব হবে।



 

 

 

 

 

 

নতুন প্রত্যাশায় ।। আকাশ বার্তা

 

 

 

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ